[english_date]।[bangla_date]।[bangla_day]

গল্পগুচ্ছ উপেন পাগল- ফজলুল হক মনোয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

গল্পগুচ্ছ
উপেন পাগল
ফজলুল হক মনোয়ার
আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। মর্নিং স্কুল। ফাস্ট বেন্জ্ এ বসতে হবে তাই খুব ভোরে দুই বন্ধুকে নিয়ে স্কুলে আসি। তখন স্কুলছিল বর্তমান গার্লস স্কুলের জায়গায়। স্কুলে ঢুকেই ভয় পেয়ে যাই। স্কুলের ভিতর কে যেন শুয়ে আছে! আমরা ভয়ে কাপতে কাপতে দপ্তরী মুকুল চাচাকে ডাকাডাকি শুরু করি। মুকুল চাচা চলে আশে, একজন নোংরা চাদর গায়ে দেওয়া দাড়িওয়ালা লোক ঘুমিয়েছিল, আমাদের শব্দ শুনে তার ঘুম ভেংগে যায়। একটু পরে উঠে চলে যায়। তার বগোলের নীচে একটা পোটলা। আমরা মুকুল চাচার কাছে জানতে চাইলাম, পাগলটাকে? চাচা বললো, ওনার নাম উপেন, উনি একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পাগল হয়েছে। পরে জানতে পারলাম উনি কোন এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। রানীবালা নামে একটি মেয়ের সাথে তার প্রেম ছিল। এক সময় তারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করবে। কোন কারনে তাদের পরিবার বিয়েতে রাজি ছিল না, তাই বাধ্যহয়ে নিজেদের গোপনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিয়ের বাজার করতে উপেন মাষ্টার সিরাজগঞ্জ যায়। বাজার নিয়ে ফিরে এসে জানতে পারে রানীবালার অন্যছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে, সাথে সাথে সে পাগল হয়ে যায়। আর কোনদিন সে ভালো হয় নাই। তার ধারনা ছিল, রানীবালার অনিচ্ছাতে বিয়ে হয়েছে। তাই তার একটাই কথা ছিল ” রানীবালা খারাপ হতে পারে কিন্তু বেশ্যা হতে পারে না “। এই বাক্যটিই তার জপনা ছিল। এর পরে প্রায়ই তাকে স্কুলে ঘুমাতে দেখেছি। আমাদের ভয় ভেংগেগেল। যেহেতু উনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন, তাই স্কুলই ওনার বেশী পছন্দ ছিল। এভাবে অনেক দিন কেটে গেল। উনি কাউকে মারতেন না। একদিন কয়েক জন দুষ্টপ্রকৃতির সিনিয়র ছাত্র তার বগলের নিচে কি আছে, দেখার জন্য চেষ্টাকরে। অনেক জোরাজুরির পর তার পোটলাটা খুলে দেখেতে পায়, একখানা আয়না, একখানা শাড়ী, চিরুনী , কিছু সোনার গহনাপত্র সহ বেশকিছু। পরে ছাত্ররা ওগুলি ফেরত দেয়। একদিন উনি আমাদের বাড়ীতে আসলেন, আমার পড়ার ঘর খুজেবের করলেন। আমি পড়ার ঘরেই ছিলাম। তখন সম্ভবত অষ্টম অথবা নবম শ্রেণীতে পড়ি। আমাকে বললেন , খোকা, তোমার মাকে বলো আমার এই চাউলগুলি ভেজেদিতে। আমি জানতে চাইলাম চাউল ভেজে কি হবে? উনি বললেন খাব। আমি বললাম, আপনাকে ভাত এনেদেই? উনি অস্বীকৃতি জানালেন। আমি চাউলগুলি নিয়ে মাকে দিলাম। মা ভেজেদিলেন। উনি খেতে খেতে চলেগেলেন। এর পর থেকে প্রায়ই একাজ করে দিতে হতো। নিদৃষ্ট কিছু বাড়ীতে ভিক্ষা করতেন এবং নিদৃষ্ট কিছু বাড়ী থেকে চাউল ভেজে নিতেন। একদিন মাকে চাউল ভাজতে দিয়ে এসে ইংরেজি পড়তে বসেছি। ওনি আমার কাছে বসে আছেন, চাউল ভাজা আসার অপেক্ষায়। হঠাত আমার কিছু উচ্চারণে ভূল ধরে এর শুদ্ধ উচ্চারণ বলেদিলেন অর্থসহ। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, ” কাকা, তুমিতো ভালো ইংলিশ জান “! কাকা বললো “আমার মাথা যখন ভালো থাকে, তখন সব পারি, কিন্তু যখন ভালো থাকে না তখন সবকিছুই গন্ডোগোল লাগে “। এর পর থেকে প্রায়ই আমাকে সাহায্য করতেন ইংলিশ, বাংলা, অংক সহ সকল বিষয়েই। একদিন অংক পারছিলাম না। তখন সম্ভবত দশম শ্রেণীতে পড়ি। কাকা আসলেন চাউল ভাজার জন্য। আমি অংকটা দেখালাম। উনি বলেদিলেন, কিন্তু পারকাম না। তখন বাধ্য হয়ে আমার খাতায় অংকটা করে দিলেন । আমাকে বললেন তুমি এটা দেখে দেখে খাতায় তোল। আমি তার হাতের লেখাটা রাখতে চাইলাম, কারন হাতের লেখা খুব সুন্দর । কিন্তু রাখতে দিলেন না। জানতে চাইতেই বললেন, ” এলেখা যার জন্য, সে তো নেই “। আমি অংকটি খাতায় তোলার সাথে সাথে তার করা অংকটি খাতা থেকে ছিড়ে নিয়ে খেয়ে ফেললেন। এভাবে অনেক দিন চললো। আমি লেখাপড়া শেষ করে চাকুরীতে গেলাম। একদিন খবর পেলাম কাকা মারাগিয়েছেন। স্কুলে শুয়ে থাকা অবস্হায় তার মৃত্যু হয়।
এভাবেই পূথিবী থেকে বিদায় নিলেন একজন ব‍্যর্থপ্রেমিক স্কুল শিক্ষক।
এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে সেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *